বাংলা ভাষার প্যাঁচাল

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!

বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এবং সকল প্রজন্মের পাণ্ডিত্যের বিজ্ঞরা বাংলা গানের এই দুটি বাক্য উচ্চারণ করার অধিকার আজ হারিয়ে ফেলেছে। এই প্রচ্ছদে আমি ভারত এবং ভারতীয় বাঙালিদেরকে লক্ষ্য করে কোনো কথা বলার অধিকার রাখছি না। একজন বাংলাদেশি লেখক হিসেবে বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের উদ্দেশ্য করেই কাঁচালঙ্কার নিয়মিত এবং বার্ষিক এই প্রকাশনায় কিছু বক্তব্য রাখছি।

দুই শত বছর বিলেতি উপনিবেশিক শাসনের আধুনিক ছিটেফোটার কারণেই হোক বা বিশ্বায়নের তরঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে মাতলামির কারণেই হোক, বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত মানুষ, যার মুখে প্রমিত বাংলার ধ্বনি আশা করা যেত, তার মুখে আজ প্রমিত বাংলা তো দুরের কথা, তার মুখে যে কোনো বাক্যের মধ্যে প্রয়োজনের বাইরেও অজস্র ইংরেজি শব্দে মাখা খিচুড়ি বচন ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। আগে অন্তত লিখিত ভাষায় আমরা নিটোল বাংলার রূপটা দেখতে পেতাম। এখন খুদে বার্তা ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্লগের যুগে সেখানেও দেখি সীমাহীন অরাজগতা।

সকলের মধ্যেই একটা প্রতিযোগিতা চলছে যে সুযোগ পেলেই বাংলা বাক্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলা শব্দ প্রতিস্থাপন করে ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক, একটা বা দশটা ইংরেজি শব্দ বসিয়ে দিয়ে সকলের কাছে নিজের মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান বা শিক্ষার মানের পরিচয় বড় করে ফুটিয়ে তুলি। সোজা কথায় বলা যায় যে সকলের মানসিকতা হচ্ছে যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে নিজের জাত বাড়ে। এর কারণ বহুবিধ। ইংরেজ আমলের তৈরি বাবু শ্রেণি থেকেই এই অভ্যাসটা বিদ্যমান। তারপরে ভারত উপমহাদেশেই ইংরেজদের স্থাপন করে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা আতেলরা এখনও প্রজ্ঞা ভিত্তিক বিষয়গুলো বাংলা ভাষায় মৌখিক আকারে তো নয়ই, লিখিত আকারেও প্রকাশ করতে শিখেনি।

আর এখনকার তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের যুগে এই প্রবণতা লাগামহীন। ভিন্ন বাবা-মা থেকে পাওয়া বাংলাদেশে আমারই ভাই এবং বিভিন্ন ভাগনে ও ভাতিজাদের সাথে বাংলায় খুদে বার্তা আদান-প্রদানের সময়ে শুনতে হয়ঃ “বাংলায় টাইপ করতে আমার পেইন লাগে!”। অনেক দিন “ভাই” হিসেবে পরিচিত থাকার পর আমি হঠাৎ হয়ে গিয়েছি “ব্রো”! আমি অবশ্য শারীরিক আক্রমণের ভয় দেখিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই তাদের এই অভ্যাসটাকে গলা টিপে শেষ করে দেই। আবার বাংলা কথাই ইংরেজি অক্ষর দিয়ে লেখার ফলে অনেক ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করা হচ্ছে সুবিধার কারণে। এর ফলে মুঠোফোন টিপাটিপি করা এই প্রজন্মের ছেলে ও মেয়েরা (গ্রামের হোক বা শহরের হোক) দিনের শেষে অনেক ইংরেজি শব্দ শিখছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর বাংলা আর জানছে না, জানলে ব্যবহার করছে না এবং কালের গর্ভে সেই বাংলা শব্দগুলো হারিয়ে ফেলার পথ সুগম করে দিচ্ছে।

তাদের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে গেলেই পাল্টা শুনতে হয় “ল্যাংগুয়েজ একটা মুভিং থিং, এখন গ্লোবালাইজেশনের টাইম” – মানে ভাষা একটি চলমান বস্তু, এখন বিশ্বায়নের সময়। যারা আমাকে ভালো করে চিনেন তারা জানবেন যে আমি নিজেই বিশ্বায়নের একজন সৃষ্টবস্তু। এবং আমার ভাবনা অনুযায়ী বিশ্বায়ন মানে খিচুড়ি বচন, ব্লগ, লেখনী, সাক্ষাৎকার বা সংবাদ প্রতিবেদন নয়। বরং এটার মানে হচ্ছে বাংলা ছাড়াও ইংরেজি এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাষার পারদর্শিতা। জি! “পারদর্শিতা”। এটা কি সকলের বোধগম্য নয় যে বাংলিশ বা বাংরেজি (অর্থাট খিচুড়ি) ভাষায় পারদর্শিতা আসলে কোনো পারদর্শিতা নয়? এটা কি পরিষ্কার নয় যে বাংলার সময়ে বাংলা এবং ইংরেজির সময়ে ইংরেজি – এই মনোভাব তৈরি করে দুটা ভাষারই ভিত্তি মজবুত করে সেগুলোর বিস্তৃত মহিমা নিজের জীবনে, অর্থাৎ বচন ও লেখায় তুলতে পারাটাই দক্ষতার পরিচয়?

এই মনোভাব পোষণ করেই সময়ের সাথে সাথে আমি বাংলা ও ইংরেজি, এই দুটো ভাষার পারদর্শিতা অর্জন করেছি। সেটা লেখার সময়ে তো বটেই, কথা বলার সময়েও। বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষার ইতিহাস সম্বন্ধে বিজ্ঞরা অবশ্যই আমার মধ্যে অনেক ভুল পাবেন যা আমি আশা করবো তারা আমাকে ধরিয়ে দেবেন। আমি বাংলা ব্যাকরণ ও ইতিহাস নিয়ে তেমন কিছুই শিখতে পারিনি। বাংলা বই ও আন্তর্জালে বাংলা পত্রিকা পড়ে পড়ে ভাষার ছন্দটা ধরে ফেলেছি। তবে বাংলা বানান এখনো আমাকে মুর্খ বানিয়ে ছাড়ে। সেটাও আস্তে আস্তে অতিক্রম করার চেষ্টা করছি। প্রবাসে জীবনের বেশির ভাগটা কাটানোর পরও, এবং প্রথমে ইংরেজিতেই পারদর্শিতা অর্জন করার পরও আমাকেই বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের অনেক মানুষের তুলনায় আমি ভালো বাংলা বলি ও লিখি।
এর কারণ আমার উপলব্ধিতে এসেছে যে বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষারই দক্ষতার প্রয়োজন। বিশ্বায়ন মানে নিজের ভাষা ও সংষ্কৃতিকে হারিয়ে ফেলা নয়, বরং যেখানে ভাষার এবং জনপ্রিয় সংষ্কৃতির প্রতিযোগিতা অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার দাপট বিদ্যমান, সেখানে নিজের সত্ত্বাকে আলিঙ্গন করে রাখাটা আরো বেশি আবশ্যক। তবে সেটা ইংরেজি ভাষা ও বিশ্বায়নের সংষ্কৃতির ব্যাপকতাকে মেনে নিয়েই করা যায়। একটাকে হারিয়ে আরেকটা নয়।

এই প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিটা বাংলাদেশে এখন আর নেই বললেই চলে। এর কিছু সম্ভাব্য কারণের দিকে তাকানো যাক এবার। বাংলাদেশের উচ্চ শ্রেণির বণিকরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজিটাই ব্যবহার করে বলে সাধারণ জীবনেও বাংলা ভাষার কথ্য ও লিখিত ব্যবহার ভুলেই গিয়েছে। তারাই তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ব্যয়বহুল ও শিক্ষার নামে প্রহসন, অর্থাৎ ইংরেজি মাধ্যমের অধ্যয়ন কেন্দ্রগুলোতে পাঠাচ্ছে যেখানে সন্তানরা ছোট বেলা থেকেই শিখছে টুইংকল টুইংকল এবং চার্স ডিকেন্সের “মার্চেন্ট অফ ভেনিস”। তারা শ্রেণিকক্ষে একজন আরেকজনের সাথে বাংলা বলারও অনুমতি পাচ্ছে না, পাচ্ছে শুধু ইংরেজিতে ফ্যাটর ফ্যাটর করার আদেশ। বাংলাদেশে এই শিক্ষাটার প্রয়োজনীয়তা এবং যথার্থতাটা কী সেটার বিচার বিশ্লেষণ আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

শৈশবে কিছুটা সময় এরকম একটা স্থানে পাঠ করার দূর্ভাগ্য হয়েছিল বলে আমি সাক্ষী যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাষ করা হয় স্বদেশ, স্বীয় সংষ্কৃতি ও মাতৃভাষার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা কিছু ফিরিঙ্গির জাতকে, যারা নিজেদেরকে অধিকতর উচ্চ ভেবে বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিচু মনে করে ক্ষ্যাত উপাধি দিয়ে থাকে (ঢাকার বাইরে গ্রামে গঞ্জের ছাত্র-ছাত্রীরা তো জন্তু-জানোয়ার!)। এই কৃত্রিম উপগ্রহদের দৈনিক স্বপ্ন ও আকাঙ্খা বিদেশ পাড়ি দেয়া বলে নিজের দেশ তো দূরের কথা, নিজের এলাকাটাকেও ভালোভাবে চেনার প্রয়োজন মনে করে না এরা। করলে বড় জোর কোনো আভিজাত্যপূর্ণ বিপনী কেন্দ্র, আইস্ক্রীম পার্লার, বিউটি পার্লার, শরীরচর্চা কেন্দ্র, দামী কফির দোকান, রেস্তোরাঁ বা পাঁচ তারা হোটেলের লবি। বাকিটা বাংলাদেশ (তার বিভিন্ন ভৌগলিক স্থান) ও দেশের মানুষ, সমাজ, দেশের ইতিহাস, দেশের সমস্যা, ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্য সম্বন্ধে এরা একই সাথে অজ্ঞ এবং উদাসীন।

এদেরকে বাংলায় কিছু একটা লিখতে দেয়া আর মাথার চুল ছিড়ে ফেলা একই কথা। আর এদের বাংলা বচন? কোথা থেকে একদল ফিরিঙ্গির মাথায় এলো যে বাংলা কথাগুলো ইংরেজি বা বিদেশি কায়দায় মুখ বাঁকা করে উদ্ভটভাবে উচ্চরণ করাটাই সময়ের দাবী। আর যারা তা করছে না, তাদের খিচুড়ি ভাষা অনেকটা ভারতীয় “ইন্ডিয়াজ বেস্ট ড্যান্সার” অথবা “ইন্ডিয়ান আইডল” নামের টিভি অনুষ্ঠানের বিচারকদের হিন্দি বচনের মতো, যা শুনলে আমার গায়ে কেরোসিন ঢালতে ইচ্ছা করে। এখানে বলে রাখা উচিৎ যে আমি নরেন্দ্র মোদির রাজনীতি ভীষণ অপছন্দ করলেও তার হিন্দি বচনকে মধুময় মনে করি, কারণ তিনি হিন্দি বলেন!

অদৃষ্টের কী পরিহাস! বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও বাংলা সংষ্কৃতির বিশিষ্ট কিছু মানুষও এখন ঠিকই তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে এই সব ইংরেজি মাধ্যমে পাঠিয়ে সাংষ্কৃতিক বিকলাঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলছেন। আর বিলেতি আমল থেকেই আমাদের অবচেতন মনে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে যারা ইংরেজি বলে তারা জাতের মানুষ। তারা “ইস্মার্ট”, তারা ভদ্র। তাই ঢাকা ও অন্যান্য শহরের ইংরেজি মাধ্যমগুলোতে চাষ করা এই বাংরেজগুলোর প্রভাব সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের বাকি আনাচে কানাচেও পড়ছে। যেহেতু ইংরেজি শব্দ শিখলেই ও ব্যবহার করলেই মানুষ “কুল” হতে পারে, সেহেতু একজন ট্যাক্সি চালককে আমি কিছুতেই ঢাকা বিমানবন্দরের “অভ্যন্তরীণ” টার্মিনালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজী করাতে পারলাম না। “ডোমেস্টিক” বলার সাথে সাথেই তিনি আমাকে ঘোড়ার বেগে সেখানে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ শব্দটা কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে।

এক তথাকথিত ভাইকে আমি কিছুতেই তার জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে আসতে বলতে পারলাম না। অনেক কষ্ট করে তাকে তার এনআইডটা আনতে বোঝাতে পেরেছি। আর ঢাকার রিকশা চালক ভাইদেরকে যে কখনোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে বলা যাবে না তা অনাদিকাল থেকেই স্বীকৃত। তারা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ছাড়া আর কিছুই চিনেন না। তারা কোন শব্দটা বাংলা এবং কোন শব্দটা ইংরেজি সেটাও জানে না। একজন নামী-দামীর মুখে কী যেন একটা (ইংরেজি) শব্দ শুনেছে সেটাকে তারা বাংলা শব্দই মনে করছে এখন থেকে।

আমি অনেক লেখককে চিনি যারা বাংলা বই লিখতে পারেন, কাব্য রচনা করতে পারেন কিন্তু খিচুড়ি মার্কা ভাষা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না। এই প্রহসন একেবারে সমাজের উচ্চ স্তর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে নিচের স্তরগুলোর গায়ে বেয়ে বেয়ে নেমে এসে সব কিছুকে শিক্ত করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিটাকে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন বা চলমান প্রক্রিয়া বলে মনে করে বসে বসে আঙ্গুল চুষলে চলবে না। একটু ভাবতে হবে এটা কী হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে।
বাংলা ভাষা ও সংষ্কৃতিকে কেন্দ্র করে যেই বাংলাদেশটার জন্ম, বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের যেই পরিচয়, এবং যেই স্বাধীনতার বীজ বপন করা ভাষা দিবস উদযাপন করাটা আমাদের বার্ষিক রীতি, সেখানে সেই ভাষাটার বিবর্তনটাকে অস্বাভাবিকভাবে এবং কৃত্রিমভাবে প্রভাবিত করার দায় আমাদের সকলের। এবং এই দোষ শুধু বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যম ব্যবসাগুলোরই নয়, বরং একই সাথে দেশের সকল মাদ্রাসাগুলোরও, যেখানে আরবি, ফারসি, উর্দু ও কিছু ইংরেজির দাপটের কারণে কোনো মাদ্রাসার ছাত্র বা সেখান থেকে বের হয়ে আসা হুজুর বা ইমামের বাংলা বচন একেবারেই অশ্রাব্য।

এর সমাধান কী? এবার যা বলতে যাচ্ছি তা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমার ভারতীয় পাঠক বন্ধুদেরকে এখনই বলে রাখছি যে ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্যের বিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণের রূপরেখা ভারতীয়রাই নির্ধারণ করবে। আমি শুধু বাংলাদেশের কথাই বলছি এখানে। আমার মতে বাংলাদেশে উপরে বর্ণিত সব কিছুর সমাধান হলো বাংলা মাধ্যমে একটি অতি উন্নত, আধুনিক, সার্বজনীন এবং সম্পূর্ণ একমুখি, ধর্মনিরপেক্ষ, বাংলা সাহিত্য ও সংষ্কৃতিমনা, কারিগর ও প্রযুক্তি ভিত্তিক এবং বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষা ব্যবস্থা যা সবার জন্য সমানভাবে লভ্য হবে (অর্থাৎ সরকারি)৷ এখানে আধুনিক উপায়ে একটি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সবাইকে ইংরেজিও শেখানো হবে। এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে গড়ে তুলতে হবে প্রতি বছর সরকারি বাজেটের ৫% এই খাতে ব্যয় করে। এবং এই বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থাটা গড়ে তুলতে হবে এই লক্ষ্য নিয়ে যে অভিভাবকরা সেচ্ছায়েও কোনো দিন তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ইংরেজি বা মাদ্রাসা মাধ্যমে আর পাঠাবে না, কারণ সেগুলোর আর প্রয়োজনই পড়বে না।

যে সকল বামপন্থীরা সামাজিক সাম্যতা বলে দিনরাত মুখে ফ্যানা তুলেন (সাথে নিজের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম ও পরে যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়ে দেন), তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে একটা দেশে শিক্ষার ভিন্নতা মানুষের মাঝে যেই বিভাজন তৈরি করে, তার পরিধি ব্যাপক এবং সার্বজনীন। বামপন্থী অর্থনীতি কায়েম না করেও একটি দেশে সম্পূর্ণ সরকারি ও একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা (ও স্বাস্থ্য খাত) তৈরি করতে পারলে মানুষের মাঝে শ্রেণি বিভাগ এমনিতেই কমে যায়। আর বাংলাদেশে এই শিক্ষার মাধ্যম বাংলায় হলে ফ্যাটর ফ্যাটর করা ফিরিঙ্গিরা আঞ্চলিক বাংলা বলা মানুষদের ছোট মনে করবে না, প্রমিত বাংলা বলার চেয়ে ভুলভাল ইংরেজি মিশিয়ে খিচুড়ি বলাটাকে আরেকটু “কুল” মনে করবে না, শিক্ষিত একজন কৃষক ভাই কখনোই তার চেয়ে কম শিক্ষিত কিন্তু বিত্তবান একজন ব্যাবসাইয়ের চোখে ছোট হবে না। কারণ সেই শিক্ষাটা ছিল বাংলায়, এক্মুখি এবং সার্বজনীনভাবে লভ্য – মানুষের বিত্তের উপর সেটা নির্ভরশীল ছিল না।


এবার নিশ্চয়ই ভাবছেন যে কাঁচালঙ্কায় এই বিশদ সামাজিক বিশ্লেষনের সাথে সমকামী (নারী ও পুরুষ), উভকামী, রূপান্তরকামী, রূপান্তরলিঙ্গ, রূপান্তররূপী, আন্তলিঙ্গ, লিঙ্গতরল, অদ্বৈত, অযৌন ইত্যাদি মানুষদের কী যোগাযোগ? বাংলাদেশের যৌন সংখ্যালঘু (এলজিবিটি) সম্প্রদায়ের মানুষগন এত কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে কী করবে? উত্তর হচ্ছে যে উপরে উল্লেখিত সব কিছুই বাংলাদেশের যৌন ও লিঙ্গ সংখ্যালঘু সমাজটার ভেতর নোংরাভাবে প্রতিফলিত। ধর্ম বিশ্বাস (এর বিভিন্ন মাত্রা) এবং ধর্ম অবিশ্বাস – এগুলো যেমন যৌন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টাকে বিভক্ত করে রেখেছে, ঠিক তেমনি ভাষা ও সংষ্কৃতিকে কেন্দ্র করে আরো বিভাজন আমাদেরকে কাবু করে রেখেছে।

বাংলাদেশে প্রথম সমকামী সংগঠন তৈরি হয় ঢাকার অভিজাত এলাকার বিত্তবান অভিভাবকদের ইংরেজভাষী ছেলেদের নিয়ে। তাদের অনেকেই এখন স্বীকার করে যে সেই সংগঠনে সমাজের একই স্তরের বাইরে সমকামীদের কোনো জায়গা ছিল না। আরো পরে সেই অভিজাত এলাকার বাইরে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে থেকে সমকামী ছেলে ও কিছু মেয়েদের সাথে অনলাইনে পরিচয় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে এদের প্রতিনিধিত্ব করার কেউ ছিল না। এরা বাংলাভাষী হওয়াতে উপরে উল্লেখিত সংগঠনের কাছে অগ্রসর হওয়ার সাহস পেত না। অগ্রসর হলে অনেককেই নাক উঁচু ব্যবহার পেয়ে ফিরে যেতে হতো।
আমি বাংলা ভাষায় এলজিবিটি অধিকার বিষয়ক কর্মকান্ডের অপ্রতুলতা লাঘব করতে বাংলাদেশের এবং সমগ্র বাংলাভাষী যৌন সংখ্যালঘু এবং তাদের শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করি বৈচিত্র্য নামের তথ্য ও সৃজনশীলতা ভিত্তিক একটি জালপাতা। অনেক মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা সেখানে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। অনাকাঙ্খিত কারণবশত আমার একার পক্ষে বৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও চালানো আর সম্ভব নয় বলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি এই পাতাটি সম্প্রতি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমি সংশ্লিষ্ট অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ স্থাপন ও ব্যবহার করার উপর জোর দিয়েছিলাম যা কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। Sexual Orientation আমার কাছে যৌন প্রবৃত্তি (সামান্য উদাহরণ স্বরূপ)।

বাংলা ভাষায় (এবং উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করে) আমরা আমাদের মনের ভাব লিখিত এবং মৌখিকভাবে প্রকাশ করতে শিখে যৌন ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে আমাদের করে নিয়েছি। এগুলো পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা ভীমরতি নয়। হাজার হলেও ভারত উপমহাদেশে আমরা হাজার বছর ধরেই আছি, শুধু মনের ভাব প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাইনি। এখন যেহেতু পেয়েছি, তাই এখন যেন ফ্যাটর ফ্যাটর করা একটি দল বাকিদেরকে আলাদা করার সুযোগ না পায়। বাংলা ভাষায় আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার আদলে বাংলাদেশের সকল শহর ও গ্রাম ভিত্তিক সমকামী, রূপান্তরকামী, অদ্বৈত ইত্যাদি মানুষদের মাঝে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একটা বিভাজনকে আমরা যেন অতিক্রম করতে পারি।

আর এর জন্যই মন্দ্র ও নবপ্রভাত-এর প্রচেষ্টায় আমি মুগ্ধ। বাংলা ভাষায় এদের নেট ভিত্তিক প্রকাশনা বাংলাদেশের সকল স্তরের এবং সকল স্থানের যৌন সংখ্যালঘুদেরকে সহজেই আমন্ত্রণ জানাতে পারবে। এখানে কোনো অভিজাত শ্রেণির দাপট থাকবে না। আর সব শেষে কাঁচালঙ্কার প্রতি অশেষ ভালোবাসা তো রইলোই।

ছবিঃ ভুটান


<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *