বন্ধু লেখক গৌর দাস বসাককে লেখা কয়েকটি চিঠি

১ স্পেন্স’স [হোটেল]
ক্রিসমাস দিবস,১৮৬৮

প্রিয় গৌর,
তোমার পাঠানো জিনিসপত্রের জন্যে ধন্যবাদ। তোমার শোবার ঘরের অপূর্ব তেল-ছবিটি আমাকে এমনই অভিভূত করেছে যে, ওটা যদি তোমার এককালীন বন্ধুর ছবি না-হত তাহলে সেটি আমাকে উপহার দেবার জন্যে তোমাকে অনুরোধ করতাম। কিন্তু এমন একটা স্মৃতিচিহ্ন থেকে তোমাকে বঞ্চিত করতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সুতরাং, আমার বিশ্বাস, ওটি আমাকে ধার দিতে তোমার অমত হবে না- অবশ্য তুমি যদি ওটি তোমার নতুন কর্মস্থলে নিয়ে না-যাও। তোমার ঐ পরিত্যক্ত ও স্যাঁৎসেঁতে ঘরে যতটা যত্নে আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি যত্নে ওটা রাখব। এ বিষয়ে তুমি কী বল, ধাড়ি বালক! তুমি যখনই এ-শহরে ফিরে আসবে কিংবা লিখবে তখনই তুমি এটা ফেরত পাবে।


১৮৬৯র একটি চিঠি

আমার প্রিয়তম গৌর,
গতকাল আমি এক বন্ধুকে নিয়ে বালী পেরিয়ে কয়েকটি গ্রাম দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সময়-মত ফিরতে না-পারায় তোমার ওখানে যাওয়া হল না। আজ জ্ঞানেন্দ্র ঠাকুরকে নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকতে হবে। আগামী কাল আমি অসীম আনন্দে তোমার বাড়িতে “ডালভাত” খাব। ইতিমধ্যে আমার প্রতি তোমার অনুরাগের উত্তাপ যেন ঠাণ্ডা হয়ে না-যায়, দেখো। তাড়াতাড়িতে,তোমার


১৮৬৯

প্রিয় গৌর,
কি আশ্চর্য ব্যাপার। গতকাল সারাটা দিন আমি তোমার কথা ভেবেছি, এবং নিজেকেই বার-বার জিজ্ঞেস করেছি এ বছর তুমি বাড়ি ফিরছ কি না। আমি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, এখন সেরে উঠেছি। আমার পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমি খুব খুশি হব,পুরনো দিনের অনেক কথা বলা যাবে। আগামী মঙ্গলবারের বিকেলবেলা কি তোমার সুবিধে হবে? তা যদি হয়,জানিয়ো।
পুনশ্চঃ তুমি জান,বিশেষ জরুরি কোনো খবর দিতে না-হলে আমি কখনো চিঠি লিখিনে। আমাকে অপদার্থ পত্রলেখক বলে তবে উড়িয়ে দিয়ো না।


মার্চ ১৮৬৯

প্রিয় গৌর,
শতসহস্র ধন্যবাদ। তোমার প্রাক্তন বন্ধুটির এই চিত্রের যত্ন নিতে আমি কসুর করব না। ঈশ্বর তোমা সহায় হোন, হে বন্ধু! আবার আমাদের দেখা হবে কবে? আমাকে চিঠি লিখো,আমার কথায় বিশ্বাস রেখো,আমি উত্তর দেবই – এ শপথ করছি।


৭ ওল্ড পোস্ট অপিস স্ট্রীট
৩১ মার্চ ১৮৬৯

প্রিয় গৌর,
কয়েকদিন আগে আমাকে বর্ধমানে যেতে হয়েছিল,সেখানে আমাদের বাঙালী অভিজাত সম্প্রদায়-ভুক্ত ব্যক্তির এক শীর্ণ নমুনার সঙ্গে দেখা হল, তিনি জনৈক কুমার – রায়মল্লিক সম্ভবত। তিনি আমার দিকে বেশ দৃষ্টি রেখেছিলেন,এবং তোমার একটা চিঠি দেখালেন। চিঠিটা আমি যদিও পড়িনি, কিন্তু তখনই আমার মনে হয়েছে,এখনো ভাবছি, তুমি ঐতিহাসিক কবতক্ষ নদীর তীরবর্তী জায়গায় সফর সেরে তোমার মূল ঘাঁটিতে ফিরে এসেছ; আরও ভেবেছি বাগেরহাট থেকে লেখা তোমার চিঠির উত্তর দেওয়া আমার উচিত ছিল। আমার কথা বলতে পারি, আমাদের দেশের ঐ অঞ্চলটির স্মৃতি আমার কাছে কিছুটা ঝাপসা। কিন্তু তোমার মত খোশমেজাজী মানুষের সঙ্গে ঐ জায়গাগুলো আবার দেখার আমার বিশেষ আপত্তি নেই। আমি যদিও সর্বান্তঃকরণে ইচ্ছা করি যে, তুমি অন্য কোনো সভ্য অঞ্চলে খুব তাড়াতাড়ি বদলি হও। যুত ঢা রং [রজলাল] হুগলিতে এসেছে,তাকে অস্বাভাবিক মোটা ও স্বাস্থ্যবান দেখাচ্ছে। ভয়াবহ ও একঘেয়ে যশোরের বদলে তুমি কি কোলেদের ভূমি পছন্দ কর না, এবং তার জন্যে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেল না?দপ্ত্রের কাজে মন একেবারে বিভোর থাকলে অলস চিন্তার জন্যে মনের আর কোনো সময় থাকে না, এ অবস্থা ছাড়া,আমি ধারণাই করতে পারি নে, মানুষে কি করে ওখানে বাস করে।
ঠাকুর বনাম ঠাকুর সেই বিরাট মামলাটি মিটে গিয়েছে। এখনো রায় বের হয়নি। বাদী পক্ষের আমি একজন কৌঁশুলি ছিলাম, “ডেইলি নিউজ” পত্রিকায় রিপোর্টারের নজর থেকে আমার নামটা এড়িয়ে গেছে যদিও।
আমি যে ঠিকানা দিয়ে এই চিঠি লিখছি তার থেকেই তুমি বুঝতে পারবে, আমি হাইকোর্টের আরিজিন্যাল সাইডে প্র্যাকটিস করতে আরম্ভ করেছি। আপীলের আদালতে বর্তমানে বিশেষ কোনও কাজ নেই- হায় রে,কী ভীষণ এই স্ট্যাম্প য়াক্ট! আজকাল মামলামোকর্দমা হচ্ছে ধনী ব্যক্তিদের বিলাস মাত্র।
ভাইসরয় পাহাড়-অঞ্চলে গিয়েছে,কলকাতা এখন নীরস নিস্তেজ হয়ে আছে। থিয়েটারের লোকেরা আর অপেরা-ওয়ালারাও সকলেই চলে যাচ্ছে।আমি অনেক সময় ভাবি লখনউএ পাড়ি দিলে কেমন হয়; কিন্তু সেখানে আমার এমন কেউ নেই যে নাকি আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দেবে বলে নির্ভর করতে পারি। আমাদের এই এলাকায় দু-এক জন সেখানে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যে ভাগ্য ফিরিয়ে নিয়েছে।
আমাদের মধ্যে কবে নাগাদ ফিরে আসতে পারবে বলে মনে করছ? আমার মনে হচ্ছে পুজোর ছুটির আগে সম্ভব নয়। তুমি ধারণা করতে পারবে না সেই ছবিটা কীরকম অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। একজন ইউরোপীয় আর্টিস্টকে দিয়ে আমি ওটা একটু সংস্কার করিয়ে নিয়েছি।


১৮৬৯

প্রিয় গৌর,
তোমার চিঠি আমার হাতে পৌঁছবার একটু আগে আমার কন্যা শর্মিষ্ঠা হঠাৎ মূর্ছা গিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পড়ে। (কয়েক সপ্তাহ আগে তার মা ও ভাইয়েদের সঙ্গে সে ফিরে এসেছে ভারতবর্ষে)। ভাগ্যক্রমে ডাক্তার পামার এখানে ছিলেন। কণ্যাটি এখন ভালো আছে- ঈশ্বরের আশীর্বাদ। যে-কোনো দিন ১০টার পরে ৭ং ওল্ড পোস্ট অপিস স্ট্রিটে আমার সঙ্গে দেখা কর,তার পর আমরা এখানে ফিরে আসব,তখন শ্রীমতী দত্ত ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও দেখা হবে। তাড়াহুড়োতে,তোমার


৭ ওল্ড পোস্ট অপিস স্ট্রীট
৩০ জুলাই, ১৮৬৯

প্রিয় বুড ঢা গৌর,
তুমি ধারণাই করতে পারবে না তুমি শহর ছেড়ে যাবার আগে আমি তোমার সঙ্গে একটু কথাও বলতে পারলাম না বলে আমি কতটা দুঃখ বোধ করেছি, তোমার চেম্বার তখন শাঁসালো মক্কেলে পূর্ণ! তুমি যদিও একজন হাকিম, …এত শুল্ক আদায় করা তোমার সাধ্য নয়। যাই হোক, দুঃখপ্রকাশ বৃথা, কেন না তুমি এখন আছ সুন্দরবনের বেশ স্বাস্থ্যকর অঞ্চলে,আর তোমার এই দীন দাস পড়ে আছে ওল্ড পোস্ট অপিস স্ট্রীটের হট্টগোলের মধ্যে।কিন্তু ছুটি এসে গেল,তখন নিঃসন্দেহে ,পুরনো বন্ধুদের বেশ একটা জমাট জমায়েত হবে। ইতিমধ্যে তোমার মহিমান্বিত অনুগ্রহলাভের আকাঙ্ক্ষায় এই পত্রবাহককে একটু সুপারিশ করার অনুমতি দাও ,এ’কে আমি আগে কখনও দেখিনি,কিন্তু সে আমার কাছে এসেছে কাটিপাড়ার আমার এক বুড়ো ধূর্ত খুড়ো বংশীধর ঘোষের কাছ থেকে অতি চমৎকার এক চিঠি নিয়ে। এর জন্যে তুমি যদি কিছু করতে পার আমি অনুগৃহীত হব। মনে হচ্ছে, তার এমন ধারণা হয়েছে যে আমার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যেতে পারলেই তার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই জন্যে এই চিঠি। সুপারিশ-পত্র দেওয়া আমি একেবারেই পছন্দ করি নে, কিন্তু এমন এক-একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায় যে, অন্যের জন্যে একজন অসহায় পাষণ্ডকে তার মনোবৃত্তির উপরেও পীড়ন করতে হয়।
তোমাকে দেওয়ার মত বিশেষ কোনো খবর নেই। এখানে আমাদের বড় একঘেয়ে কাটছে, যদিও এখন সেই ঈশ্বরীর বিরুদ্ধে আমার কোনো নালিশ নেই, কবিরা যাঁর নাম দিয়েছেন “চপলা”।আমার ব্যবসায়ে বেশ মুনাফা হচ্ছে। আমার বাড়ির সকলে এখন উত্তরপাড়ায় আছেন, শীঘ্রই আমরা চন্দননগরে উঠে যাব। আমি এই শহরেই আটকে আছি, কেননা শহরের বাইরে বাস করা বিলাস মাত্র যা আমি কিছুতেই করতে পারিনে। কারণ ব্যবসায় আরম্ভ করেছি সবেমাত্র… এই নীরস ও নির্বোধ চিঠির জন্যে ক্ষমা কোরো। আমাকে একটু বেরোতে হবে, সুতরাং বিদায়।


১৮৭২

প্রিয় গৌর,
এই পত্রবাহকটি তোমার কাজের ঠিক উপযোগী হবে। এ একজন সেরা পাচক ইত্যাদি অত্যাদি।তুমি যদি একে তোমার নতুন গৃহে উপযুক্ত কাজ দিতে পার তাহলে এমন সুবিধাজনক ব্যক্তিকে নিয়োগের জন্যে তোমাকে আক্ষেপ করতে হবে না। দ্বারকানাথ ঠাকুর,কিশোরী এবং তোমার এই দীন লেখকের কাছে এ কাজ করেছে। তাড়াহুড়োতে ,তোমার


১৮৭২

প্রিয় গৌর,
আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, তুমি যে-চিঠির কথা লিখেছ আমি সে-চিঠি দেখিই নি।তা যদি দেখতাম তবে তখনই উত্তর দিতাম।
তোমার জানা উচিত আমি হাকিম বাহাদুর নই,আমাকে তাই রোজ বের হরে হয়।
এ কথা কি তোমাকে খুলে বলতে হবে যে,আমার আয়ত্বের সবটা সময়ই তোমার? অতি অবশ্য এসো, আম সর্বদা যা অনুভব করতাম এবং স্বর্বান্তঃকরণে করি সেই আন্তরিক বন্ধুত্বের সেই প্রতিশ্রুতিটা এখানে এসে আমার মুখ থেকেই শুনো।


১৮৭২ ফেব্রুয়ারী, মঙ্গলবার

প্রিয় গৌর,
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি প্রায় মরেই গিয়েছিলাম এবং আমাকে যেতে হয়েছিল ঢাকা,যেখানে ১০ দিন আটকে পড়েছিলাম, তার পর অনেক কষ্টে ফিরে আসি। জানতে পারলাম তুমি স্বাস্থ্যহানির জন্যে ছুটিতে আছ। যত শীঘ্র সম্ভব তোমার সাথে দেখা করব।
তোমার জন্যে এই সঙ্গে এক কপি “ইলিয়স” পাঠালাম।তোমার পুত্রের সম্বন্ধে এবং তার ইউরোপ-যাত্রা সম্বন্ধে তোমাকে আমার অনেক-কিছু বলার আছে।


১৮৭২

প্রিয় গৌর,
আমি আমার পুরাতন আবাস ত্যাগ করেছি। আমার এই নূতন গৃহে তোমার মত প্রিয়তম বন্ধুকে পেলে আমি পরম আনন্দলাভ করব।হায়, আমি শোচনীয় অবস্থায় আছি। এস,একবার দেখে যাও তোমার অযোগ্য ও স্নেহময় এম এস ডি।

ছবিঃ ভুটান


<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *