একটি ল্যাভেণ্ডার ম্যারেজ এবং ভারতীয় সমাজ , বধাই দো (২০২২)

স্পয়লার সতর্কতাঃ এই লেখাটি পড়ার পরে ছবিটি দেখার মজা পণ্ড হতে পারে বা ভেস্তে যেতে পারে।

২০২২ এর ফেব্রুয়ারীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি বধাই দো। রাজকুমার রাও, ভূমি পেডেনকর, চুম দারাঙ্গ,গুলশান দেবাইয়াহ,শিবা চাড্ডা প্রমুখ অভিনীত ছবিটি পরিচালনা করেছেন হর্ষবর্ধন কুলকার্ণী। চিত্রনাট্যও তাঁরই।

ছবির বিষয়বস্তু “ল্যাভেণ্ডার ম্যারেজ”, অর্থাৎ একপ্রকার আপোসের বিয়ে,যেখানে পাত্র-পাত্রী নিজেদের যৌন-পরিচয় পরষ্পরকে জানিয়েই, সহমত হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে ওঠেন,সমাজের চোখে বিসমকামী যুগল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য। কিন্তু না, শুনতে যতোটা সহজ মনে হল, ব্যাপারটা আদৌ অতোটাও সহজ নয়। যাই হোক, ছবির কথায় আসি, ২ ঘন্টা ২৭ মিনিটের এই ছবিটিকে আমরা মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি, বিরতির পূর্বের প্রথমার্ধ সম্পর্ক গড়ে ওঠার গল্প, এবং বিরতির পরের অর্ধ আবর্তিত হয় কাম আউট এবং একটি শিশু দত্তক নেওয়াকে ঘিরে।

সমকামীতা সম্বন্ধে অজ্ঞ মানুষের ধারণাগুলি, একে অপ্রাকৃতিক হিসেবে মনে করা, অসুস্থতা হিসেবে মনে করা, ঘৃণা করার চিরাচরিত প্রবণতা যেমন উঠে এসেছে কিছু চরিত্রের সংলাপে, তেমনই এসবের পাশাপাশি, সমপ্রেম সম্পর্কে প্রেম, দ্বিচারিতা, প্রতারণা, বিচ্ছেদও উঠে এসেছে এই ছবিতে। কখনও বা পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হয়েছে সুমনের পার্টনারকে, কখনও বা, অন্য কারোর হাত ধরে শার্দূলের পার্টনার চলে গেছে। মান-অভিমানের পালাও রয়েছে। ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে সমপ্রেমের নানান দিক তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে ছবিটিতে।

ছবির প্রথমেই আমরা দেখতে পাই, স্কুলে শারীরশিক্ষা বিভাগের শিক্ষিকা সুমন সিং (ভূমি) পরিবারের চাপে নাজেহাল। একবার চাপের মুখে আশির্বাদ পর্যন্ত গেলেও ভাবী স্বামীর দুর্ঘটনায় মৃত্যু তাকে কিছুটা স্বস্তি দেয় বিয়ের হাত থেকে। কিন্তু, তারপরেও প্রবল চাপ আসতে থাকে বিয়ের জন্য।

ওদিকে, পুলিশে চাকরিরত শার্দূল ঠাকুর (রাজকুমার) সমকামী,কিন্তু পরিবারের কাছে জানাতে অপারগ। তাই, নানা রকম গল্প বানিয়ে বাড়ির লোককে ঠেকিয়ে রাখতে রাখতে ক্লান্ত হয় পড়ে। ওদিকে, ডেটিং সাইটে রাজু নামের একটি ছেলে সুমনকে এক্সপোস করে দেবার ভয় দেখিয়ে উত্যক্ত করতে থাকলে সুমন বাধ্য হন পুলিশের সাহায্য নিতে। সে সময়েই শার্দূলের সাথে আলাপ সুমনের। শার্দূল এবং সুমন প্ল্যান করেন, বাড়ির চাপ থেকে বাঁচতে, বিয়ে করবেন তাঁরা। এভাবেই কাহিনীর সূত্রপাত। হানিমুনে গিয়ে দেখা যায়, দুজনের আলাদা রুমে থাকছেন এবং শার্দূলের বয় ফ্রেন্ড কবির এসে পৌঁছান। কবিরের অবশ্য শার্দূল-সুমনের বিয়ে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। পরবর্তীতে দেখা যায়, কবিরের সাথে শার্দূলের বিচ্ছেদ ঘটে কবিরের অসততার জন্য। ওদিকে সুমন ,রিমঝিম(চুম) নামের একজন প্যাথোলজিস্টের প্রেমে পড়েন। কাহিনীতে জটিলতা শুরু হয়, যখন রিমঝিম এসে সুমনের সাথে থাকতে শুরু করেন।

দেশের বাড়ি থেকে শার্দূলের মা (চরিত্রটিতে শিবা চাড্ডা অসাধারণ অভিনয় করেছেন) শার্দূলের কোয়ার্টারে আসবার পর থেকে এক রকম চোর-পুলিশ খেলাই শুরু হয় ছেলে-বৌমার সাথে মায়ের। শার্দূলের জ্যেঠীমা(সীমা পাহ্বা চরিত্রটিকে অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ) ফোনে ফোনে নানান ইনস্ট্রাকশন দিতে থাকেন শার্দূলের মাকে। অনন্যোপায় শার্দূল শেষে ফলস রিপোর্ট বানিয়ে পরিবারে জানায় যে সে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। শার্দূলের মা দেশের বাড়ি ফিরে যেতে চান ,কিন্তু, ট্রেন মিস করেন। তারপরেই আসে গল্পে অন্য মোড় এবং নানা রকম স্তরে স্তরে সম্পর্কের নানান বোঝাপড়া,নানান পরত দেখা যায়। কিন্তু না, গল্প এর বেশি বলে ফেললে উৎসাহী দর্শকের প্রতি অন্যায় করা হবে। বাকিটুকু জানতে পর্দায় চোখ রাখতেই হবে।

সমকামী মানুষের অসহায়তা এই ছবিতে অনেকাংশেই ধরা পড়েছে। পরিবার, পরিজনকে নিজের মনের কথা খুলে বলতে না পারার ব্যথা, সারাক্ষণ বিসমকামীর চরিত্রে অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, নিজের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে চাপা দিয়ে রাখার যন্ত্রণা ব্যক্ত হয়েছে। আবার, রাজু নামের ছেলেটি সুমনকে যখন ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে, সেও তো রোজকার জীবনেই ঘটে চলা ঘটনা। না জানি , এরকম কত শত সুমনকে চাপের মুখে পড়ে রাজুদের মতো ছেলেদের বিছানায় চলে যেতে হয়, স্বেচ্ছায় ধর্ষিত হতে হয়।

কত হাজার হাজার শার্দূলকে নিজের যৌন-পরিচয় গোপন করে, কর্মস্থলে কাজ করে যেতে হয়।পরিবারের কাছে দিনের পর দিন বাধ্য হয়েই মিথ্যাচার করতে হয়। পরিবারের সাথে চোর-পুলিশ খেলতে হয় এবং কম্প্রোমাইজ করে বিয়েতেও বসতে হয়। আইনী স্বীকৃতি পাবার পরেও অপরাধীর মতো জীবন কাটাতে হয়। পেশায় চিকিৎসক জামাইবাবুর মুখেও সংলাপ শোনা যায়, সমকামীতা অস্বাভাবিক,এটা রোগ। সুমনকে নিজের ছোট ভাইয়ের কাছে শুনতে হয়, সমকামীতা আসলে পার্ভারশন। আর কিছু নয়। যেখানে সুমনের মা বলে ফেলেন, সুমন কেন মরে গেলো না! সুমনের বাবা চোখের জল ফেলেন, “আমার পরিবারেই কেন”! সেখানে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা শার্দূলের মা কিন্তু সমকামী সন্তানকে নির্দ্বিধায় বুকে টেনে নেন। এক সময় দেখা যায়, সুমন যেমন নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে খুব কনফিডেন্ট, সাহসী, শার্দূল কিন্তু, নিজের পরিচয় গোপন করতেই বেশি বিশ্বাস করে, সর্বদা চেষ্টা করে সমাজের সামনে, কাজের জায়গায় “নর্মাল” সেজে থাকার। এই দুই বৈপরিত্তের মধ্যেও ধীরে ধীরে একটা সমীকরণ তৈরী হয়। শার্দূল-সুমনকে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখে রিমঝিমের রিয়্যাক্ট করা, রাগ – অভিমান, সবই পর্দার চরিত্রগুলোকে রক্তমাংসের চরিত্রে রূপান্তরিত করে। নানান কমেডি দৃশ্যের আড়ালে অন্তরালে ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে সমপ্রেমীদের যন্ত্রণা, বুকফাটা হাহাকার, অসহায়, দমবন্ধকর পরিস্থিতি। আবেগাপ্লত দর্শক আনমনে চোখের কোণা মুছে নেন তখন।

একটি সমপ্রেমী বিবাহের দৃশ্যে দেখা যায়, গুরু নারায়ণ (শার্দূলের প্রেমিক) রঙ্গীন মুখোশ পরে থাকলে, শার্দূল তাকে মুখোশ পরা নিয়ে প্রশ্ন করে। আবার সেই শার্দূলই ছবির শেষে প্রাইড ওয়াকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জনৈকের থেকে মুখোশ নিয়ে পরে ফেলে। দর্শকের মনকেও এই প্রশ্ন ভাবিয়ে তোলে, শার্দূলরা এভাবে কতোদিন নিজেদের মুখোশের আড়ালেই রেখে দিতে বাধ্য হবেন?

শিবা চাড্ডা, সীমা পাহ্বা এবং সুমনের বাবা-মা হিসেবে লাভ্লিন মিশ্র ও নিতিশ পাণ্ডে ,সকলেই অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ছবিটিতে ব্যবহৃত গান এবং ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর বেশ মন ছুঁয়ে যায়। সুনিধী চৌহান, তানিষ্ক বাগচি, অঙ্কিত তিওয়ারি, অমিত ত্রিবেদী রয়েছেন সঙ্গীতের দায়িত্বে। প্রাইড ওয়াকের দৃশ্যগুলি হৃদয়স্পর্শী। সব মিলিয়ে একটা ভালোলাগার ঘোর ঘিরে থাকবে বহুক্ষণ। কাঁচালঙ্কার বন্ধুদের বলবো, অপেক্ষা না করে, একবার দেখেই ফেলুন!

ছবিঃ https://twitter.com/JungleePictures/status/1485848384171024386

<< কালিজা ২০২২ (৫ম বর্ষ) – সূচীপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *