সিনেমাঃ ভিক্টিম (১৯৬১)

(লেখাটি সম্ভবত বঙ্কু পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত, লেখার সময়ের সামাজিক এবং আইনি অবস্থানের সাথে বর্তমানের কিছু পার্থক্য রয়েছে।)

স্পয়লার সতর্কতাঃ এই লেখাটি পড়ার পরে ছবিটি দেখার মজা পণ্ড হতে পারে বা ভেস্তে যেতে পারে।

পরিচালকঃ বাসিল ডিয়ারডেন

সালটা ১৯৬১, স্বাধীন ভারত সবে কৈশোরে। বাংলাদেশ পয়দা হয়নি। আমেরিকা আরো আট বছর পরে স্টোনওয়াল রায়টের সম্মুখীন হবে। ইংল্যান্ড আর ওয়েলসে “সেক্স্যুয়াল অফেন্স য়্যাক্ট” বলবত, যা এখনকার ভারত বা বাংলাদেশের ৩৭৭ ধারার মতো সমকামীদের মানবাধিকার পুরোপুরি অস্বীকার করে। আমেরিকা হোক বা ইংল্যান্ড, যেই সময় সমকামীদের নোংরা, অসুস্থ, বিকৃত, অসামাজিক ইত্যাদি নামেই সমাজ ডাকতে সচ্ছন্দ বোধ করে, ঠিক সেই সময় বোমা ফাটানোর মতো এলো এই সিনেমা, “ভিক্টিম”। প্রথম ইঞ্জিরি ছবি যাতে “হোমোসেক্স্যুয়াল” বা সমকামী শব্দটা ব্যাবহার করা হয়। নামজাদা অভিনেতা ডির্ক বোগার্ডকে অন স্ক্রিন বলতে শোনা যায়, “আমি ঐ ছেলেটির সাথে সম্পর্ক বন্ধ করেছি, কারন আমি ওকে কামনা করা শুরু করে দিয়েছিলাম।” এই সবে ছবিটি দেখে উঠলাম। মুখের ভাষা আপাতত হারিয়ে গেছে। তাই আঙুলের চাপে না হয় খানিক আবল তাবল টাইপ করা যাক।

ভিক্টিম অর্থে শিকার। খুব সোজা ভাবে দেখলে এই রোমহর্ষক ছবির গল্প ঘুরপাক খায় সমকামী পুরুষদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা ঘিরে। মূল চরিত্র ব্যারিস্টার “ফার”, তার স্ত্রী “লরা”, তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক এক সহানুভূতিশীল সমান্তরাল সৃষ্টি করে যায় ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি। গল্প শুরু এক হতভাগ্য যুবক “ব্যারট”কে নিয়ে। আইনি সংজ্ঞায় সমকাম সেই সময় অপরাধ, আর ফার তখন বিবাহিত, তাই ব্যারটের প্রতি ফার আকর্ষিত হলেও কখনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেনি। ব্ল্যাকমেলারদের টাকার ফরমায়েশে অতিষ্ঠ, সামান্য রোজগেরে ব্যারট, যোগাযোগের চেষ্টা করে ফার-এর সাথে। ফার তাকেই সন্দেহ করে ব্ল্যাকমেলার হিসেবে এবং এড়িয়ে চলে। এদিকে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যারট গ্রেপ্তার হয়, আর থানার মধ্যে নিজের এবং ফার-এর সম্মান বাঁচাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। ফার যখন এ ব্যাপারে জানতে পারে, তখন ব্যারটের এক বন্ধুর সাহায্যে ব্ল্যাকমেলারদের বিরুদ্ধে শুরু করে গোপন অভিযান। কিন্তু ধিরে ধিরে সেও ব্ল্যাকমেলারদের শিকার হয়। এই জায়গায় এসে ধন্ধ। পুলিশের কাছে না গেলে ব্ল্যাকমেলারদের কাছে নতিস্বীকার। আর গেলে ক্যারিয়ার, স্ত্রী, সংসারের জন্য এক অদ্ভুত অপমানকর পরিস্থিতি। এর পরের গল্পটা না হয় রহস্যই থাকুক। আর তাছাড়া, ব্ল্যাকমেলারদের চিহ্নিত করাটা ছবির খানিক-উদ্দেশ্য হলেও, আমার লিখতে বসার উদ্দেশ্য একেবারেই নয়।

আমি ভাবছিলাম সময়, — এখন এইখানে এইদেশে, যেখানে আমি লিখছি, কতোটা পাল্টেছে? এটা ২০১৭ তো? ১৯৬১ নয় তো? কিন্তু আমি তো আমার চারপাশটাই ফুটতে দেখছিলাম সাদাকালো পর্দায়। কারন ভারত বা বাংলাদেশের নিরিখে এই ছবি আরো প্রাসংগিক। এখনো এখানে ৩৭৭ আছে, যা ঐ ইংল্যান্ড থেকে আসা, মহারানীর বাচ্চাগুলো ফেলে গেছিলো। আর আমরা বহাল তবিয়তে তাকে বয়ে বেরাচ্ছি। পুরো ছবি জুড়ে যেমন উঠে এসেছে সমাজের সমকামিতার প্রতি ঘৃণা, তেমনি ফুটে উঠেছে সমকামীদের যন্ত্রণা, তাদের মানুষ হিসেবে দেখাতে চাওয়ার আকুতি। অভিনয় প্রত্যেকেরই দুর্দান্ত হলেও, “ফার” চরিত্রে “ডির্ক বোগার্ড”-এর অভিনয় বিশেষভাবে চোখে পড়বেই।

ইংল্যান্ডে ছবিটা অদ্ভুত কিছু কারনে সেইসময় শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের দেখানোরই ছাড়পত্র পায়, আর আমেরিকায় বিশিষ্ট প্রযোজক সংস্থা ছবিটির সাথে নিজের নাম জড়াতে অস্বীকার করে। “পহলাজ নিলানি”রা সব দেশেই, সব যুগেই, ছিলো-আছে-থাকবে।

আর হ্যাঁ! একটু গভীরে ভাবলে, এই ছবিতে দেখানো “ভিক্টিম” বা শিকারদের শিকারি কারা? শুধুই কি ব্ল্যাকমেলাররা? সমাজ নয়? আইন নয়?

প্রশ্নগুলো পরিশেষে রেখেই দিয়ে যাই। উত্তরগুলোরও তো কিছু উত্তরদায়ীত্ব আছে, না কি?

ছবিঃ https://en.wikipedia.org/wiki/File:Victim_1961_poster.jpg

<< কালিজা ২০২২ (৫ম বর্ষ) – সূচীপত্র


1 comment on “সিনেমাঃ ভিক্টিম (১৯৬১)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *