নব্বই-এর দশকের কলকাতা ও রামধনু রঙের রূপকথারা

“সাম্য রসের উপাসনা
না জানিলে রসিক হয় না”
—– লালন শাহ

নব্বইয়ের দশকের কলকাতায় সামাজিক পরিসরে তখন বিকল্প–কামনা ঘিরে সুগভীর নৈঃশব্দ। বিকল্প-কামনা অর্থে বিসমকামের বাইরে এমন কিছু কামনা, যার মধ্যে রয়েছে সমকাম, উভকাম, রূপান্তরকাম, বিপরীতবেশধারণ প্রভৃতি। এক কথায় ছোট করে বলা চলে, LGBTQIA+ (Lesbian Gay Bisexual Transsexual Queer Intersex Asexual এবং অন্যান্য)। তখনও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় এসব “অ-প্রাকৃতিক”,শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সনাতনী ভারতীয় ঐতিহ্যের ও মূল্যবোধের ধারক-বাহক হিসেবে দাবী করা গোষ্ঠী, “বিদেশ থেকে আগত অপসংস্কৃতি”-র ধুয়ো তোলা স্বঘোষিত নীতি-পুলিশ, এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পিষে যাওয়া বিকল্প-কামী মানুষরা নিজেদেরকে সে সময় অন্তরালেই রাখতেন। সামাজিক সুরক্ষাই মূল কারণ ছিল অন্তরালের। দশকের শুরুতে LGBTQIA+ বা “সমকামিতা” (সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছে সে সময় LGBTQIA+ ব্যাপারটাই স্থূল অর্থে সমকাম ছিল।) বিষয়ে্ সে ভাবে, কোনও আলোচনাই হ’ত না। সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন নিরুচ্চার। তার কারণ এই নয়, যে, তারা “সমকামিতা” সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। সমকাম, উভকাম ইত্যাদি কামের অতি প্রাচীন ধারাগুলি, যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে ফল্গুধারার মতো, তা সকলেই জানতেন, এবং জীবনের কোনও না কোনও পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সম্মুখীন হননি, এমনটাও নয়। কিন্তু, আমরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে প্রান্তিক হয়েও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় নিজেদেরকে উন্নততর কল্পনা করে অন্যের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি এবং মনে করি, নিজেরাই নৈতিকতায় সেরা এবং এক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল।

আসলে, এর পিছনে রয়েছে যুগযুগান্তর ধরে চলে আসা এক জটিল রাজনীতি। উৎপাদন এবং শ্রমের মধ্যে বহুদিন হল এক সমীকরণ কাজ করছে, যার মূল প্রভাবক প্রজনন। এই উৎপাদনের দু’টি প্রধান উপাদান, নারী এবং পুরুষ। তারা শ্রমীক, শ্রম দান করেন।

এই চক্রটিই সমাজ তথা রাষ্ট্রের মূল-ভিত্তি। এখন, সমস্যা হল, এই প্রজননক্ষম শ্রমীকদের উৎপাদন-কর্মে ইচ্ছুক হওয়া, এই আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা প্রক্রিয়া বহমান রাখার জন্য একান্ত প্রয়োজন। ফলতঃ সন্তান উৎপাদিত হয় না, এরকম যৌনতার রাষ্ট্রের কোনও প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই ধর্মীয় সংগঠনগুলিরও। সে কারণেই “অস্বাভাবিকত্ব”-এর অছিলায় নানান বিধিনিষেধ, দণ্ডের অবতারণা। বিকল্প-কামনাগুলি যে কেবল এবং কেবলমাত্র কোনও সংখ্যালঘু ব্যক্তিসমষ্টির কামকেন্দ্রীক জীবনচর্চা নয়, বরঞ্চ লিঙ্গ-বিষয়কচর্চা (যৌনতা নয়, যৌনতা শব্দের উৎপত্তি যোনি থেকে, যা শুধুমাত্র নারীর কামকেই প্রকাশ করে, পুরুষ বা তৃতীয়লিঙ্গ বা লিঙ্গ-অনির্নিত মানুষের নয়) প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এই সহজ ও চিরায়ত সত্যটিকেই ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আসলে যৌনতা-কে আমরা মোটামুটি ভাবে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছি।(যদিও Desmond Morris তাঁর “The Human Zoo” গ্রন্থে যৌনতাকে দশটি ভাগে ভাগ করেছেন) “প্রজনন-মুখী যৌনতা” (procreational sex), যা বংশবিস্তারে সহায়ক এবং “আশ্লেষ-মুখী যৌনতা” (recreational sex), যেখানে মানুষ প্রজননের তোয়াক্কা করেন না, শুধু আনন্দের জন্যই যৌনতা বা কাম। কাম-কে গবেষকগণ মূলতঃ দেহ-কেন্দ্রিক বলেছেন। বলেছেন কাম লিঙ্গ-চর্চা চায়, আশ্লেষ চায়। আবার, প্রেম মূলতঃ মন-কেন্দ্রিক। প্রেমে সংযম সুস্পষ্ট, কাম অনেকটাই অসংযমী। আবার, ফ্রয়েড বলেছেন কাম এবং প্রেম একই উপাদানে গঠিত, পার্থক্য কেবল লক্ষ্যে (aim)।বাঙালীর লালল শাহ-ও বলেছেন,

“বলবো কি সেই প্রেমের কথা
কাম হ’ল সেই প্রেমের লতা” ।।

তারপরেও, শুচিবায়ুগ্রস্ত বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিসরে কামের তুলনায় প্রেম শব্দটি অনেক বেশী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রেম “নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়” । যেখানে কাম-ক্রিয়ার পরেই স্নান সেরে শুচি হতে হয়, সেখানে সেই কাম যদি হয় বিকল্প-কাম, ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটবে, সহজেই অনুমেয়।

বাঙালী সমাজের বৃহত্তর অংশের মানসিকতায় সে সময় প্রজননমুখী কামই একমাত্র কাম্য ছিল, আশ্লেষের গুরুত্ব ছিল ঠিক ততোটুকুই, যতটুকু প্রজননের সময় প্রয়োজন। ফলে, আশ্লেষ-মুখী কাম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সেই অর্থে এবং আ-শৈশব নারী-পুরুষের বাইনারিতে অভ্যস্ত হয়ে আসা মানুষ “সমকাম” শব্দটি শুনলেই ভীত হয়েছেন বা ঘৃণা করেছেন (মূলতঃ উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের কথাই বলা হল। নিম্নবিত্তদের মধ্যে এতোটাও ছুঁৎমার্গ ছিল না, অনেককেই বলতে শোনা যেত যে “সন্তান সমকামী, কি আর করা যাবে, ঈশ্বরের বিধান মেনে নেওয়াই ভালো।”জীবিকার্জনই প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রসঙ্গতঃ এই উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেনীবিভাজনের বিষয়টি কার্ল মার্ক্স এবং ম্যাক্স ওয়েবার আলোচনা করে গিয়েছেন, পরবর্তীতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন The Argumentative Indian (2005)গ্রন্থে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। এই স্বল্প পরিসরে সেই বিস্তৃতীতে আলোচনা করলাম না।) সে সময়ে কেউ সমকামী পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইলে, “ও, তুমি সমকামী”? বলে মুখ বিকৃতি থেকে শুরু করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মানসিক এবং শারীরিক নিগ্রহ করা, সবই ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। কোনও পুরুষের নারীসুলভ হাবভাব দেখলেই তাকে “বৌদী”, ”লেডিস”, ”ছক্কা” বলে টোন কাটা, উত্যক্ত করা, গায়ে হাত তোলা, সবই চলতো। কিছু মানুষ এই ক’দিন আগে পর্যন্ত দাবী করতেন, সমকামিতা এক ধরণের রোগ, যা সঠিক চিকিৎসায় সেরে যায়। এবং চিকিৎসার নাম করে দিনের পর দিন অত্যাচার করা, গৃহবন্দী করে রাখা, ইলেকট্রিক শক থেরাপি এসব চলতেই থাকতো। নারী-সমকামীদের উপর আরেক রকম অত্যাচার চলতো। যৌন নির্যাতন করা হ’ত, কোনও পুরুষের দ্বারা ধর্ষণ করানো হ’ত পরিবারের অনুমতিতেই, নানাভাবে “বোঝানোর” চেষ্টা করা হ’ত, পুরুষের সাথে সঙ্গম কতোটা “সুখের”।এর পোষাকি নাম হল সংশোধনমূলক-ধর্ষণ(corrective-rape)। কিছু মানুষ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মুখ বুঁজে বসে পরতেন বিয়ের পিঁড়িতে, সারা জীবন এক প্রবল অসুখী দাম্পত্য-কে বয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হ’তেন, দিনের পর দিন নিজের আত্মা, নিজের সত্তাকে হত্যা করতে বাধ্য হ’তেন। বলাই বাহুল্য, বিবাহিত-সঙ্গীটিরও জীবন খুব একটা সুখের হ’ত না।আবার, বিয়েতে রাজী না হওয়ায় অনেককে অনেক রকম সামাজিক এবং মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে, অনেকে সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হ’তেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকেই সংবাদ-মাধ্যম মুক্তচিন্তা-কে অনেক বেশী প্রাধাণ্য দিয়ে এসেছে, অন্ততঃ সেই সময়ে। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাতেই একের পর এক প্রকাশ পেতে থাকে আত্মহননের খবর। তার সাথেই ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ পায়। মধ্য ভারতে দু’জন মহিলা পুলিশ কনস্টেবল লীলা এবং ঊর্মিলার বিবাহের সংবাদ। আশার কথা, ঊর্মিলার পরিবার এই সম্পর্ককে সমর্থন জানিয়েছিলেন। মানবতাবাদী, নারীবাদী, সমানাধিকারকামী সমাজকর্মী এবং মুক্তচিন্তকরা আলোচনা এবং ভাবনার নতুন খোরাক পেয়েছিলেন। কিন্তু না, একটা ঘটনা, তা সে যতো যুগান্তকারীই হোক না কেন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে না। লীলা-ঊর্মিলার বিবাহের এক দশক পরেও, ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যাতে মমতা (১৯) এবং মোনালিসা(২৪)কে মৃত্যু বরণ করতে হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে ১৯৯২ খৃষ্টাব্দের ১৬ই এপ্রিল (Indian Express সূত্রে প্রাপ্ত) রাজাপুর গ্রামের সীমান্তে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় দু’জন কিশোরী রেখা (২২)এবং গায়েত্রীর(১৮) মৃতদেহ। গায়েত্রীর সিঁথির সিঁদুরই বলে দেয়, আত্মহননের আগে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, পরিবার তাদের বিয়েতে বাধা দেওয়ায় তাদের এই পথ বেছে নিতে হল। তারা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে স্বামী-স্ত্রী হয়ে কাটাবার স্বপ্নটুকু নিয়ে ইহ-জীবনের ওম ছেড়ে মৃত্যুর শীতলে পাড়ি জমায়। বীণা ওয়াংখেড়ে এবং নন্দিতা গায়কোয়াড়,সঞ্জয়-উৎপল, এরকম অসংখ্য প্রণয়ীযুগলকে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হয়। মৃত্যুর পরেও যাতে আলাদা না হতে হয়, তাই পরষ্পরের হাতে হাত বেঁধে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেওয়ার কথাও সংবাদপত্রেই প্রকাশ পায়।এক যুগলের সংবাদ প্রকাশ পায়, নিজেদের জীবন শেষ করে দেবার আগে, পরিবারের কাছে তাদের আর্তি ছিল, উভয়ের দেহই যেন একই চিতায় দাহ করা হয়।যদিও সে কথা রাখা হয়নি। পাঠক মুখে আলোচনা না করলেও, খবরগুলি পড়তেন অবশ্যই, কেউ কেউ সহমর্মীও হতেন হয়তো। কিন্তু, ওই টুকুই।

সেই সময় আর এক প্রকার কাম-চর্চিত হত, “লউণ্ডা” নাচিয়েদের সঙ্গে। ১৫-২৫ বছর বয়সী অনেক নারীসুলভ যুবকরা এই পেশার সাথে যুক্ত হন। বিপরীতবেশ পরিধান করে, প্রসাধন করে তারা পারি জমান উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে। সাধারণতঃ গ্রীষ্ম এবং শীতের শুরুতে এরা যান, এবং তিন/চার মাস পর টাকা, নতুন কাপড়, এমনকি নতুন পুরুষ সঙ্গী নিয়েও ফেরেন।(Dancing Boys: Traditional Prostitution of Young Males In India শীর্ষক রিপোর্ট হতে প্রাপ্ত) নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে সেখানে এই লউণ্ডা নাচ হয়। এর পর, অধিকাংশ সময়েই তারা অনুষ্ঠানের পুরুষ উদ্যোক্তাদের শারীরিক সুখ দিতে বাধ্য হন। অনেক সময় অমানবিক অত্যাচারের শিকার হতে হয় এই সব লউণ্ডা নাচিয়েদের।রক্তাক্ত দেহেও সারারাত মনোরঞ্জন করে যেতে হয়। মারন-রোগের শিকারও হতে হয়। তথাকথিত নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসার কারণে, এদের সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীকে এরা তোয়াক্কা করতেন না, দু’মুঠো অন্ন সংস্থানই মূল লক্ষ্য ছিল।

এছাড়াও ছিল এক মারণ-ব্যাধীর ভয়, Human Immunodeficiency Virus (HIV)। অ-সুরক্ষিত যৌনতা এর সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম। যেহেতু বিকল্প-কামীদের একটি বৃহৎ অংশ সে সময় নিরোধের ব্যবহার করতেন না, এই রোগ ধীরে ধীরে থাবা বসাচ্ছিল।যদিও বিকল্প-কামী, বিসমকামী নির্বিশেষে সবাই আক্রান্ত হ’তেন, কিন্তু, আঙুল উঠতো শুধুমাত্র বিকল্প-কামীদের দিকেই। ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে “এইডস ভেদভাব বিরোধী আন্দোলন” (Anti-AIDS Discrimination Campaign,ABVA নামেই সম্যক পরিচিত)-র সূচনা হয়। এ-সময় নানা স্বেচ্ছা-সেবী সংগঠন AIDS রোগীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য বড়ো শহরগুলির gay cruising zone গুলিতে বিনামূল্যে নিরোধ বিতরণ এবং সচেতনতার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হন তারা। এ প্রসঙ্গে ABVA প্রকাশিত “Less Than Gay” প্রতিবেদনটি উল্লেখযোগ্য। লিফলেট, নিউজলেটার প্রকাশ করে সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছে সংস্থাগুলি। বহু ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদেশ থেকে অর্থসাহায্যও পেয়ে চলেছে এই কর্মকাণ্ডে।

এছাড়াও নানান ধর্মীয় সংগঠন নিরলস প্রচার চালিয়ে যেত, “সমকাম বিদেশ থেকে আমদানি করা, যার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক কস্মিনকালেও ছিল না” । এর কারণ অনুসন্ধানে Ruth Vanita বলেছেন, “This is partly because same-sex love in South Asia seriously under-researched as compared to East Asia and even West Asia. With a few exceptions, South Asian scholars by and large ignore materials on homosexuality or interpret it as heterosexual.” (Homosexuality in India: Past and Present, Vanita, 2004) এ কারণেই সু-প্রাচীন বিকল্প-কামের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, অস্বীকার করা সহজতর হয়েছে।

সমকামী নারী-পুরুষদের তুলনায়, সম্ভবতঃ কিছুটা “ভালো” অবস্থায় ছিলেন উভকামীরা। যেহেতু সমাজের পছন্দসই প্রজনন-মুখী যৌনতায়-ও তারা সামিল হ’তে পারতেন, সমাজের কাছে তারা আত্মগোপন করতে পারতেন অতি সহজেই। তবে, উভয় লিঙ্গের সাথীর সঙ্গেই যৌনসংসর্গ তখনকার সমাজ কখনই ভাল চোখে দেখবে না, সেটা অনুমেয়।

আমরা জানি, আমাদের লিঙ্গ-পরিচয় শুধুই দৈহিক নয়, মগজ এবং মননে আমরা যা, সেটাই আমাদের আসল লিঙ্গ-পরিচয়। রূপান্তরকামীরা সে সময় সব থেকে কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। দেহে এক অথচ অন্তরের উপলব্ধি ভিন্ন, এরকম ভাবে জীবন অতিবাহিত করা এক দুর্বিসহ ব্যাপার। বিদেশে সম্ভব হলেও, ভারতে সে সময় জেণ্ডার রিএসাইনমেন্ট সার্জারী সহজ ছিল না এবং এই বিশালব্যায়বহুল অপারেশন করার মতো আর্থিক আনুকূল্য সকলের হ’তও না। সমাজের ভ্রূকুটি-কে তুচ্ছ করে অল্প সংখ্যক মানুষ-ই বিপরীতবেশ ধারণ (crossdressing) করার সাহস রাখতেন।

আলোর এক বিন্দু-উৎস যেভাবে তিমিরবিদার হয়ে ওঠে, সেভাবেই, এই অন্ধকারের প্রাকার ভেদ করে আলোর দিশা দেখা গিয়েছিল। আমরা বলে থাকি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প-সংস্কৃতি সমাজের দর্পণ। সেই দর্পণে কখনও প্রকট, কখনও প্রচ্ছন্নভাবে ধীরে ধীরে বিকল্প-কাম প্রতিফলিত হতে শুরু করে এই সময়েই, এই বিরুদ্ধ, প্রতিকুল পরিবেশেও।

সংবাদপত্র নিঃসন্দেহে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে এই সময়। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত (পড়ুন elite class) এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ঘরে বিকল্প-যৌনতা সংক্রান্ত খবর মূলতঃ সংবাদপত্র, ক্রোড়পত্র, পত্রপত্রিকা এবং দূরদর্শনের মাধ্যমেই পৌঁছেছে। মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছে, প্রান্তিকযৌনতা ও লিঙ্গ-পরিচয়ের মানুষরা এখনও exist করেন। নব্বই এর দশকের বাংলা পত্র-পত্রিকা এ ব্যাপারে অগ্রণী।

তখন আমি স্কুলে পড়ছি, প্রাথমিক বিভাগ, ১৯৯৫ সাল নাগাদ, তখনকার দিনে, ইস্ত্রী(iron)-র দোকান থেকে জামা-কাপড় ইস্ত্রী করে, খবরের কাগজে মুড়িয়ে, সুতো দিয়ে বেঁধে, বাড়িতে পাঠান হ’ত। সেরকমই এক খবরের কাগজের মোড়কে দেখেছিলাম, কলকাতায় সমকামিদের পত্রিকা প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। তখন জানতাম না, বুঝতামও না, আজ জানি, পত্রিকাটির নাম ছিল প্রবর্তক। পত্রিকাটির pen-friend কলাম থেকে মনের মতো বন্ধু খুঁজে নিতেন অনেকেই। সমকামী মানুষদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, নানা সমস্যার সমাধান জানিয়ে লেখা প্রকাশিত হতো পত্রিকাটিতে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, কমিকস নানান বিভাগ ছিল। মূলতঃ ইংরেজীতে লেখা হলেও, বাংলা, অল্প হিন্দি লেখাও ছাপানো হতো। কলকাতার মিডলটন স্ট্রীট এর ক্লাসিক বুক স্টল এবং দিল্লীর পার্লামেন্ট স্ট্রীটের পিপল ট্রী-তে পাওয়া যেতো পত্রিকাটি। ১৯৯১-১৯৯২ এর মধ্যে তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রবর্তক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন রঞ্জন এবং পবন ধল।

প্রবর্তক পত্রিকাটি থেকে জানা যায়, কাউন্সেল ক্লাব-র কথা, ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। শিয়ালদহ ডেন্টাল কলেজের পাশেই ছিল কাউন্সেল ক্লাবের দ্বিতীয় অফিস। মাসে অন্ততঃ একবার মীটিং হ’তই, নতুন সদস্যরা এসে যোগও দিতেন। ১৯৯৩ থেকে প্রবর্তক পত্রিকাটি কাউন্সেল ক্লাবই প্রকাশ করতে শুরু করে। ১৯৯৫ এ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “নয়া প্রবর্তক” এবং ২০০০ সালে শেষ সংখ্যাটি প্রকাশ পেয়েছিল।পত্রিকাটি মূলতঃ ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু হয়েছিল, এর পর মৌখিকভাবে বিজ্ঞাপিত হতে থাকে এবং ব্যক্তিগত চেনাজানার স্তরেই এর বিতরণ সীমাবদ্ধ থাকতো। পরবর্তিতে, পত্রিকাটি নির্দিষ্ট কিছু বই এর দোকানে পাওয়া যেতে শুরু করে স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে।

এছাড়াও, হামসফর ট্রাস্ট প্রকাশিত, অশোক রাও কবি সম্পাদিত “বম্বে দোস্ত” (Bombay Dost) পত্রিকাটি পাওয়া যেতো। জনপ্রিয় পত্রিকাটি ভারতবর্ষের প্রথম রেজিস্টার্ড LGBTQIA+ পত্রিকা। পত্রিকাটি ১৯৯০-এ প্রকাশ পেলেও, হামসফর ট্রাস্ট গঠিত হয় ১৯৯৪ এর এপ্রিলে।

১৯৯৫ থেকে “স্ত্রী সঙ্গম”(Stree Sangam অধুনা labia) নামে একটি সংস্থার হাত ধরে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল,“স্ক্রিপ্টস”(Scripts)। অধুনা মুমবাই থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। এটি মূলতঃ সমকামী নারী, উভকামী নারী এবং রূপান্তরকামীদের জন্যই প্রকাশিত হ’ত। এই পত্রিকাটিও প্রথমদিকে ব্যক্তিগত পরিসরে, মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে বিতরণ করা হ’ত। পরবর্তিকালে কিঞ্চিৎ অনুদানের ব্যাবস্থাও করা হয়েছিল। লেবিয়া প্রচারিত “হামারি জিন্দেগি, হামারি চয়েস” স্লোগানটি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। লেবিয়া, প্রান্তিক-যৌনতা এবং লিঙ্গ-চেতনার মানুষদের জন্য নানা সভার আয়োজন করতো। এরপর, শুধুমাত্র নারীদের কথা না ভেবে, বিকল্প-কামনায় বিশ্বাসী সমস্ত মানুষের জন্য পত্রিকাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে নয় নয় করেও ১৪টি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছিল পত্রিকাটির। পাশাপাশি LGBTQIA+ বিষয়ক সাহিত্য-পাঠের সভা এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করতো লেবিয়া।সর্বোপরি, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের LGBTQIA+ সংস্থাগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর মঞ্চ গড়ার ক্ষেত্রে লেবিয়া অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। সর্বভারতীয় ইংরেজী দৈনিকগুলির মাধ্যমে অনেকেই এই পত্রিকাগুলির নাম এবং সংস্থাগুলির কাজের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন ধীরে ধীরে।

এছাড়া, মূলধারার পত্রিকার মধ্যে আনন্দলোক, প্রসাদ, সানন্দা, গ্রাফিটি (টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাথে প্রকাশিত ক্রোড়পত্র)প্রভৃতি মোটামুটি লক্ষ্য করলে বিকল্প-যৌনতা সংক্রান্ত নানা তথ্য সেই সময় পাওয়া যেতো।১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে দীপা মেহতা পরিচালিত ,শবানা আজzমি ও নন্দিতা দাস অভিনীত “ফায়ার” নামক চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।সীতা এবং রাধা দুই জা, যাদের স্বামীদের একজন বৈরাগ্য, অপরজন অন্য নারীকে বেছে নেওয়ায় তাদের নিঃসঙ্গ জীবনে, একেই অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে, মানসিক এবং শারীরিক ভাবে।সিনেমাটি জনমানসে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে।প্রায় প্রতিটি অগ্রগণ্য সংবাদপত্রে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, রিভিউ প্রকাশিত হয়।দুই নারীর সমকামের গল্প পেজ থ্রী-র হেডলাইন হয়ে দাঁড়ায়।

ফায়ার ছাড়াও, বম্বে বয়েজz (Bombay Boys) সিনেমাটি ১৯৯৮ সালেই মুক্তি পায়। তিন জন অনাবাসী-ভারতীয় যুবক, ভারতে ফিরে আসে নিজ নিজ তাগিদে। তাদের একজন সমকামী। ছবিটিতে তৎকালীন বোম্বে শহরের বিকল্প-যৌন জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। এই সিনেমাগুলি সম্পর্কিত লেখা তৎকালীন সংবাদপত্রে চোখে পড়তো।

১৯৯৬ খৃষ্টাব্দে রাহুল বোস অভিনীত একটি স্বল্প-দৈর্ঘ্যের সিনেমা মুক্তি পায়, নাম বোমগে (BomGay), এটি সম্ভবতঃ দেশের প্রথম পুরুষ-সমকাম বিষয়ক সিনেমা।

আগের দশকের অনেক চলচ্চিত্রেই সমকামী পুরুষদের নারীসুলভ চলন নিয়ে বিদ্রূপ করা হত। Nitya Vasudevan তাঁর “Recasting the “DESIRE TO DESIRE”: Engaging with “IMPOSSIBLE SUBJECTS” in the Domain of Sexuality Politics” প্রবন্ধে লিখেছেন “In terms of representation, the stereotype came in for significant critique in the 90s-films in which “effeminate” men were caricatured, their clothing, modes of speaking, their weakness and their marginality within the filmic narrative all becoming points of contention.” ধীরে ধীরে এই প্রবণতা কমতে দেখা যায়, এবং “pansy” নন, এমন সমকামী পুরুষ চরিত্র পর্দায় দেখা যেতে শুরু করে। বাসুদেবন এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন অনুপম খের অভিনীত মস্ত কলন্দর (Mast Kalandar 1991) ছবিটির।

এছাড়াও, নব্বই এর দশকের শেষের দিকে, সংবাদ পত্র বা ক্রোড়পত্রের ব্যক্তিগত কলামে ধীরে ধীরে বিকল্প-যৌনতা সংক্রান্ত প্রশ্নাবলী দেখতে পাওয়া যেতে শুরু করে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পত্রলেখক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকতেন। তবুও, মনে করা যায়, জড়তা শিথিল হচ্ছিল এবং বিকল্প-কামে বিশ্বাসী মানুষরা নিজেদের অস্তিত্ব, নিজেদের সমস্যার কথা “মূল-ধারায়” নিয়ে আসতে সচেষ্ট হচ্ছিলেন।

১৯৯৬ সালে, বলিগঞ্জ বিড়লা মন্দিরের নীচে, বিড়লা সভাঘরে অনুষ্ঠিত হয় একটি নৃত্যনাট্য। স্যাফায়ার ক্রিয়েশনের “এলিয়েন ফ্লাওয়ার্স”।এটি স্পষ্টতঃই সমপ্রেম বিষয়ক একটি নৃত্যনাট্য। “স্বীকৃতি”(একটি LGBTQIA+ পত্রিকা, ২০০৪-র বইমেলায় পথচলা শুরু) অন্যতম প্রধাণ মুখ শ্রী সুশান্ত প্রামাণিকের কথায় “সেখানে(বিড়লা সভাঘরে) যাবার আগে আমাদের কমিউনিটির মধ্যে একটি গুঞ্জন উঠেছিল যে ওখানে একটু সাবধানে যেতে হবে,কারণ,কলকাতার মানুষজন এটাকে ভালোভাবে না-ও নিতে পারেন।ফলে একটা গণ্ডগোল হবার আশঙ্কা রয়েছে।আমরা তো ভয়ে ভয়ে সেখানে গিয়েছি আর ভাবছি এই বুঝি কিছু হল-, মুগ্ধ হয়ে গেলাম এলিয়েন ফ্লাওয়ার্স দেখে।পরদিন কলকাতার সমস্ত প্রথম সারির খবরের কাগজগুলোতে এলিয়েন ফ্লাওয়ার্স এর ভূয়সী প্রশংসা বেরিয়েছিল”।(ফিরে দেখা দিনগুলি – সুশান্ত প্রামাণিক,২০১৯)

বাংলা চলচ্চিত্রে নইব্বই এর দশকে বিকল্প-কাম সেভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।১৯৯৯ সালের জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত “বাড়িওয়ালি” ছবিটিতে প্রসন্ন নামের একটি queer চরিত্র ছিল। একটি স্বপ্নদৃশ্যে প্রসন্নকে বিপরীতবাস পরিধান করতেও দেখা যায়। এছাড়া, ২০০০ খৃষ্টাব্দে অপর্না সেন পরিচালিত “পারমিতার একদিন” ছবিটি মুক্তি পায়। শ্বাশুড়ি-বৌমার অন্তরঙ্গ স্নান-দৃশ্য বাদ দিলে, ছবিটিতে সমকামিতা খুব একটা প্রাধাণ্য পায়নি। যদিও, বাংলা পত্র-পত্রিকা, সংবাদপত্রে স্নানের দৃশ্যটি বহুবার ছাপা হয়েছিল। সমকামের প্রসঙ্গ বারে বারে আলোচিত হয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যে এ সময় খুবই অল্প কিছু রচনায় বিকল্প-কামের কথা উঠে এসেছিল, তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময়”,দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং গৌরদাস বসাকের সম্পর্কের মূল্যায়ণ রয়েছে উপন্যাসটিতে। বিমল করের “যদুবংশ”, নবনীতা দেবসেনের “বামা-বোধিনী”, কবিতা সিংহের “পৌরুষ”, আবুল বাশারের “নরম হৃদয়ের চিহ্ন” প্রভৃতি রচণায় বিকল্প-কামের কথা উঠে এসেছে। অজয় মজুমদার এবং নিলয় বসু-র বেশ কয়েকটি বই এ সময়ে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে “ভারতের হিজড়ে সমাজ”(১৯৯৭) এবং “পুরুষ যখন যৌনকর্মী”(১৯৯৯) উল্লেখের দাবী রাখে। তবে এধরণের লেখাপত্রের সংখ্যা সত্যিই হাতে গোণা। সর্বভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবশ্য কবি সুনীতি নমযোশী, কবি বিক্রম শেঠ, সাহিত্যিক ফিরদৌস কঙ্গা ১৯৮০ পরবর্তী সময় থেকেই খোলাখুলি ভাবে বিকল্প-কামের কথা বলে এসেছেন। তথাকথিত এলিট বাঙালীর বুক-শেলফে এঁরা সবাই শোভা পেতেন।

চিত্রশিল্পের দিকে তাকালে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকেই, বা আরও বেশ কিছুটা আগে থেকেই পরিতোষ সেন, প্রহ্লাদ কর্মকার, প্রকাশ কর্মকার, যোগেন চৌধুরী, বিজন চৌধুরী, মনু পারেখ, রামেশ্বর ব্রুটা, ওয়াসিম কাপুর, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত প্রমুখের শিল্পে নগ্নতা, যৌনতা, শরীর এসেছে। কিন্তু, বিকল্প-কাম সে অর্থে স্থান পায়নি। ভাস্কর্যে প্রদোষ দাশগুপ্ত, চিন্তামণি কর, শঙ্খ চোধুরী শরীর, নগ্নতা নিয়ে কাজ করলেও, বিকল্প-কাম সংক্রান্ত কাজ হয়নি বললেই চলে এবং প্রদর্শনী তো দূরের কথা।

এ প্রসঙ্গে ভূপেন খক্কড়ের কথা আলাদা করে বলতে হয়। তাঁর ছবিতে, লেখাতে বিকল্প-কামের কথা বেশ দৃঢ়তার সাথে তিনি ব্যক্ত করেছেন। তবে, খক্কড়ের কাজ সম্পর্কে সেই সময় খুব একটা অবগতির সুযোগ ঘটেনি বাঙালী মানসে।

বিশ্বকবি সেই কবেই লিখে গেছিলেন,

“অভয় মনে কণ্ঠ ছাড়ি গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশী হয়ে ঝড়ের হাওয়ায় ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে” …

১৯৯৯ সালের ৩রা এপ্রিল, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হল কলকাতার এক সমকামী-প্রণয়ীযুগলের সাক্ষাৎকার। আকাঙ্খা ও মালবিকা, লেসবিয়ান যুগল। সমাজের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে তাদের একসাথে পথচলার কথা।

১৯৯৯ সালের ২০শে জুন প্রতিষ্ঠিত হল স্যাফো (২০০৩ সালে এর নাম হয় স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি) । পূর্ব ভারতের প্রথম ও একমাত্র সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী নারীদের সহায়ক সংস্থা।

এবার আসি, নব্বইয়ের দশকের অন্তিম লগ্নে ঘটে যাওয়া এক সাতরঙা দিনের কথায়। দিনটা ২রা জুলাই, ১৯৯৯। স্টোনওয়াল আন্দোলনের ঠিক ৩০ বছর পর, কলকাতার রাস্তায় মূলতঃ কলকাতার, এবং মুম্বাই ও ব্যাঙ্গালোর থেকে আগত জনা ১৫ মানুষকে নিয়ে ঘটে যাওয়া “ফ্রেণ্ডশিপ ওয়াক”(Friendship Walk), যার বর্তমান নাম Kolokata Rainbow Pride Walk। অভয় মনে কণ্ঠ ছেড়ে মারের সাগর পাড়ি দিয়েছিল যারা সেইদিন, তারাই ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম প্রাইড ওয়াকের জন্মদাতা। কলকাতার সেই ফ্রেণ্ডশিপ ওয়াক থেকেই সারা ভারতের LGBTQIA+ মানুষদের Rainbow Pride Walk এর সূচনা হয়। সেই দিনের ছোট্ট চারা গাছ আজ আকার নিয়েছে বিশাল মহীরুহের। সেদিনের সেই ১৫ জনের ছোট্ট মিছিল আজ পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সেদিনের কলকাতাকে সাতরঙে মুড়ে দিয়ে সাম্যের কথা(Equality), সহ্যের কথা(Tolerance),ভালোবাসার কথা (Love)এবং সহমর্মিতার কথা (Solidarity) প্রচার করেছিলেন তারা। প্রত্যেকেই হলদে ট-শার্ট পরেছিলেন,যা-তে লেখা ছিল “Walk on the Rainbow”. অশোক রাও কবি, নিতীন করনি, পবন ধল, ওয়াইস খান, রফিক-উল-হক-দোয়াজ-রঞ্জন প্রমুখ ছিলেন সামনের সারিতে। পদযাত্রা কিছুদূর যাবার পর, দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়, এক ভাগ যায় উত্তর কলকাতার দিকে, আরেক ভাগ দক্ষিণ কলকাতার দিকে।পরে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যোগ দেয়, যোগদান করেন মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়(নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ)। জর্জ ভবনের সামনে পদযাত্রা শেষ হয়। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন একঝাঁক সাংবাদিক। সংবাদপত্রে প্রকাশের পর সারা দেশ থেকে তো বটেই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকেও অসংখ্য শুভেচ্ছা বার্তা এসে পৌঁছেছিল।

১৯৯৯ সালের ১২ই অগাস্ট, দৈনিক আজকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়, যার শিরোনাম “ছয় বছর ধরে মেয়ে হতে চাইছে আইআইটির কৃতি ছাত্র” । নৃসিংহ মণ্ডল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একলা চলার, মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে নারী হবার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাবার।

বিকল্প-যৌনতা, অন্য-লিঙ্গচেতনার মানুষদের কাছে নব্বইএর দশকের শুরুটা তমসাচ্ছন্ন হলেও, শেষটা ছিল চোখ-ধাঁধানো আলোকোজ্জ্বল।নতুন দিনের অনেক আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্নের বুনন শুরু হয়েছিল।খালি চোখে দেখা সাদা বর্ণের আলো বিশ্লিষ্ট হয়ে রামধনু-রঙ ছড়িয়ে পড়েছিল ভালবাসার শহর, আনন্দের শহর কলকাতার বুকে, অলিতে গলিতে, রাজপথে…

ঋণ-স্বীকার
১। The Human Zoo – Desmond Morris
২। The Argumentative Indian – Amartya Sen
৩। Homosexuality in India: Past and Present – Ruth Vanita
৪। Recasting the “DESIRE TO DESIRE”: Engaging with “IMPOSSIBLE SUBJECTS” in the Domain of Sexuality Politics – Nitya Vasudeban
৫।“মধ্যবিত্তের যৌনতা” – সোমনাথ ভট্টাচার্য,
৬।Giti Thadani, Sakhiyani: Lesbianism in Ancient and Modern India(NY,Cassell,1995)
৭।Dancing Boys: Traditional Prostitution of Young Males In India.
৮।ফিরে দেখা দিনগুলি – সুশান্ত প্রামাণিক (স্বীকৃতি ২০১৯)
… এবং নামল্লিখিত সাংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা এবং আন্তঃজল

ছবিঃ অনুষ্টুপ রায়

<< কালিজা ২০২২ (৫ম বর্ষ) – সূচীপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *